নেত্রকোণায় করোনার ধাক্কায় মহাসংকটে যাত্রা শিল্পীরা

প্রকাশিত: ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ , জুলাই ৮, ২০২১

আব্দুর রহমান, নেত্রকোণা প্রতিনিধিঃ কাজ নেই যাত্রাশিল্পীদের। তাই অনেকেই ঝুঁকছেন অন্য পেশায়। দেশের ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা শিল্প যাত্রাকে বেশ কয়েক বছর ধরেই টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। অতীতে এই শিল্পের যে বিত্তবৈভব ছিল, তা এখন বিলীনের পথে। মঞ্চে মেকআপ করা রঙিন মানুষগুলোর অবস্থা বাস্তবে ঠিক তার বিপরীত। তার ওপর করোনা যেন মহাসংকটে ফেলেছে এ অঙ্গনের মানুষদের। এ পেশায় টিকে থাকতে পারবেন কি না, সেটাই ভাবছেন যাত্রার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা।এই সময়ে করোনার কারণে একেবারেই ক্ষতির মুখে পড়বে এ শিল্প।

আনোয়ারা সাজঘরের মালিক আবুল কালাম আক্ষেপ করে বলেন, বিশ বছর ধরে এ পেশার সাথে জড়িত সরকার থেকে এ পর্যন্ত কোন প্রণোদনা পাইনি, করোনার ধাক্কায় বিকল্প হিসাবে কাপড়ের ব্যবসা নিয়ে ছিলাম দ্বিতীয় ডেউয়ে একেবারেই সব কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।এখন না খেয়ে মরতে হবে এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

প্রিন্সেস সাজঘরের মালিক ও লেখিকা প্রিন্সেস বিউটি মনে করেন, দেশে যাত্রাশিল্পের দর্শক কমে যাওয়ায় এ শিল্পের অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে শোচনীয়। এখন করোনার কারণে ধুঁকতে থাকা এ শিল্প একেবারেই বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।

যাত্রা অভিনেতা লেখক ও পালাকার রাখাল বিশ্বাস বলেন, ‘যাত্রাশিল্পের এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে শোচনীয় অবস্থা, এর মধ্যে আবার কিছু অসাধু মানুষ যাত্রার নামে অশ্লীল নৃত্য দেখিয়ে ভালো শিল্পীদের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তারপরও আমরা এখনো পালাগুলো দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হাল ছেড়ে দিতে হবে। কবে করোনা ভালো হবে, কবে মানুষের সমাগম হবে, কবে যাত্রা করার অনুমতি পাবো, এগুলো নিয়ে বড় চিন্তায় আছি।’

একটি যাত্রাদলে যন্ত্রশিল্পী, মেকআপম্যান, অভিনয়শিল্পী মিলে প্রায় ৪০ জন, কোনো কোনো দলে তারও বেশি মানুষ কাজ করেন। তাঁদের প্রায় সবাই এই যাত্রার ওপরই নির্ভরশীল। করোনায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁরা সবাই বেকার। করোনা ভালো হওয়ার লক্ষণ না দেখে কিছু যাত্রাশিল্পী পেশা বদল করেছেন। আবার কেউ কেউ সুদিনের আশায় অপেক্ষা করছেন।

দেশের প্রায় ১৫টি যাত্রাদলে অভিনয় করে সংসার চালাতেন প্রবীন জুটি চন্দন সরকার ও তার স্ত্রী সাধনা সরকার। বিগত এক বছর ধরে তাঁর আয় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটানোর কথা জানালেন তিনি। যাত্রার এই অভিনেতা বলেন, ‘কর্ম না থাকলে যা হয়। খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে। মেয়ে অসুস্থ। চিকিৎসা করাতে পারছি না। খোঁজ নিচ্ছি, কিন্তু কাজের খবর মিলছে না। অভিনয় ছাড়া অন্য কিছু আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। এখন কীভাবে চলব, কোনো উপায়ই দেখছি না। খেয়েপরে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

ড্রাম বাদক নিধু চন্দ্র দাস এর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক দিন তিনি সবজির ব্যবসা করলেও এখন রিকশা চালিয়ে আয় করে কোনোরকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন লগডাউনে তাও বন্ধ রাখতে হয়েছে।

আগে নিয়মিত অনুশীলনে মুখর থাকত যাত্রা শিল্প সাজঘর গুলো দিনরাত কাটত যাত্রার অনুশীলনে। এই ঘরে রাখা যাত্রার পোশাক, ঢোল-তবলায় জমতে শুরু করেছে ধুলাবালু।
নেত্রকোনা মিউজিক স্টাপ সমিতির সভাপতি ভক্ত চন্দ্র সরকার বলেন, ‘আমাদের নেত্রকোনা জেলাসহ দেশের যে মানুষেরা এ পেশার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের প্রায় ৯৯ ভাগই ভালো নেই। ধারদেনায় আমরা জর্জরিত। সরকার আমাদের সহযোগিতা না করলে হয়তো এই পেশাতেই আর থাকতে পারব না।

যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদ নেত্রকোনা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক বিউটি সাজঘরের মালিক আবু সাঈদ তালুকদার বলেন, গান গেয়ে সংসার চালায় যন্ত্রী থেকে শুরু তবলচি তাদের পরিস্থিতি ভয়াবহ খারাপ। তাদের দিন কিভাবে কাটছে একমাত্র আল্লাই জানেন। এদের অনেককে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না

এ অবস্থা চলতে থাকলে এ অঙ্গনের ভবিষ্যৎ চিত্র কতোটা ভয়াবহ হবে তা ভেবে এখনই শিউরে উঠছি। হয়তো সংস্কৃতি চর্চাই থাকবে না। নাম মাত্র কিছু পেশাদার যাত্রা শিল্পীকে সরকারি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পুণরায় সরকারি প্রণোদনা দেয়ার আহবান জানাচ্ছি।
যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ নেত্রকোণা জেলা শাখার সাধারন সম্পাদক একেএম এরশাদুল হক জনি জানান, কয়েক বছর ধরে যাত্রাশিল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে তার অস্তিত্ব একেবারে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আগে থেকেই বিপর্যস্ত এ শিল্পকে এখন একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে করোনা। নাটক-চলচ্চিত্র সব মাধ্যমে ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু বিকল্প হিসেবে তাঁরা ফেসবুক, অনলাইনে লাইভ করছেন। অনেকে শুটিং করছেন। কিন্তু যাত্রাশিল্পীদের সেই সুযোগ নেই। কীভাবে হাজার হাজার যাত্রাশিল্পী চলছেন নাগরিক জীবনে, এটার কেউ খোঁজখবর রাখে না।

বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদ নেত্রকোনা জেলা শাখার সভাপতি দিদারুল ইসলাম জানান করোনায় গত বছর থেকে এপর্যন্ত যাদের জন্য প্রণোদনা হয়েছে সেটা খুবই মুষ্টিমেয়, অপেশাদার ও যারা কোন দিন যাত্রার সঙ্গে জড়িত নয় তারাই কিভাবে প্রণোদনা পেয়ছে,পেশাদার খুব কম শিল্পী এ প্রণোদনা পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। এটাকে বাঁচানোর জন্য নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনা দরকার।
এ ব্যাপারে নেত্রকোণা জেলা শিল্প কলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, যাত্রাশিল্পীদের কে গতবছরের সহযোগিতা করেছি এ বছরেও করেছি, সরকার থেকে বরাদ্দ আসলে আবারো দেয়া হবে

প্রিয় পাঠক, আপনিও লিখতে পারেন আমাদের পোর্টালে। কোন ঘটনা, পারিপাশ্বিক অবস্থা, জনস্বার্থ, সমস্যা ও সম্ভাবনা, বিষয়-বৈচিত্র বা কারো সাফল্যের গল্প, কবিতা,উপন্যাস, ছবি, আঁকাআঁকি, মতামত, উপ-সম্পাদকীয়, দর্শনীয় স্থান, প্রিয় ব্যক্তিত্বকে নিয়ে ফিচার, হাসির, মজার কিংবা মন খারাপ করা যেকোনো অভিজ্ঞতা লিখে পাঠান সর্বোচ্চ ৩০০ শব্দের মধ্যে। পাঠাতে পারেন ছবিও। মনে রাখবেন দৈনিক প্রতিবাদ.কম পোর্টালটি সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জন‌্য উন্মুক্ত। তাছাড়া, স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার স্বাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিও আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবর অথবা লেখা মান সম্পন্ন এবং বস্তুনিষ্ঠ হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে। লেখা পাঠানোর ইমেইল- dailypratibad@gmail.com