আজ ঋতুরাজ বসন্ত


‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত… ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। ’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পঙক্তি। আধুনিক কোনো কবি বলতে পারেন, মনে নিরানন্দ। তাতে কী? আজ বসন্ত, পহেলা ফাল্গুন।
বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদ্যাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ’ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। ‘ছায়ানট’ বসন্ত উৎসব শুরু করে ১৯৬২ সালে। দিনে দিনে তা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
স্বাগত বসন্ত। প্রাণ খুলে তাই যেন কবিগুরুর ভাষায় বলা যায়, ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে/এত পাখি গায়…। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের আকুতি যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে- ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ/আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ/ তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/তোমার অশোকে কিংশুকে /অলক্ষ্যে রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে ।
কবির শঙ্কা থাকলেও এবারও ফুল ফুটেছে। দখিন হাওয়ার গুঞ্জরণও লেগেছে। ফাগুন হাওয়ার দোল লেগেছে বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতে। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে প্রকৃতির সবুজ অঙ্গন। মাঘের শেষ দিক থেকেই গাছে গাছে ফুটছে আমের মুকুল। শীতের খোলসে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্কন এখন অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ জানিয়ে দিচ্ছে বসন্ত এসেছে। এবং সত্যি সত্যি সে ঋতুর রাজা।
কোকিলের কুহুতান, দখিনা হাওয়া, ঝরাপাতার শুকনো নূপুরের নিক্কণ, প্রকৃতির মিলন এ বসন্তেই। বসন্ত মানেই যে পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। বসন্ত মানেই একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। মিলনের এ ঋতু বাসন্তী রঙে সাজায় মনকে, মানুষকে করে আনমনা।
‘বাসন্তী তরুণী’রা খোঁপায় গাঁদা, পলাশসহ নানা ফুল গুঁজে আর ‘বসন্ত তরুণ’রা পাঞ্জাবি ও ফতুয়ায় নতুন করে নিজেদের সাজিয়ে নেমে আসবে পথে পথে। মোবাইল ফোনে এসএমএস আদান-প্রদান, ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়ে বরণ করা হবে ঋতুরাজ বসন্তকে।
শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ কচি পাতার ধীর গতিময় বাতাস জানান দেয় নতুন লগ্নের। ফাল্গুনের আগমনে পলাশ, শিমুল গাছে লেগেছে আগুনে খেলা। মধুর বসন্তের সাজ সাজ রব সর্বত্র। পুরো প্রকৃতিতে চলছে ‘মনেতে ফাগুন এলো…’ আবহ।
এমন ফাল্গুনেই, বায়ান্নর আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনে তারুণ্যের ‘শব্দ বিপ্লব’, ‘সাহসী উচ্ছ্বাস’ ও বাঁধভাঙা আবেগে বাংলা একাকার হয়েছিল।
ঋতুচক্র এখন পঞ্জিকার অনুশাসন মানতে নারাজ! কুয়াশার চাদরে মোড়া শীত জেঁকে বসতে না বসতেই বিদায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতুচক্রেও এসেছে নতুন ব্যঞ্জনা। সময়মতো শীত আসে না, বর্ষাও তা-ই।
গ্রীষ্মের খরতাপও মানে না নিয়ম। এসবের মধ্যেও অনেকটা স্বমহিমায় দীপ্যমান বসন্ত। প্রকৃতির এ আনন্দবার্তায় নাগরিক মনও তাই উচ্ছ্বসিত।
বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায় আছে বসন্তের বন্দনা। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে নানা অনুপ্রাস, উপমা ও উৎপ্রেক্ষায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিক বাউল কবির মনকেও বার বার দুলিয়েছে, দোলাচ্ছে ঋতুরাজ বসন্ত। সেজন্যই বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের সুবাসে মন আনচান করে বাউল কবির।
গ্রামের মেঠোপথ, নদীর পাড়, গাছ, মাঠভরা ফসলের ক্ষেত বসন্তের রঙে রঙিন। চোখ বুজলেও টের পাওয়া যায় এমন দৃশ্যপট। নাগরিক ইট-পাথরের জীবনে বসন্ত এসেছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে। এমন দিনে রমণীরা বাসন্তী রঙে রাঙিয়ে তুলবে রাজপথ, পার্ক, বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশোভিত সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী। কংক্রিটের নগরীতে কোকিলের কুহুস্বর ধ্বনিত হবে ফাগুনের আগমনে।
যানজট, কোলাহল ছাপিয়ে যেটুকু প্রকৃতি নগরে মেলে, এতেই গদগদ নগরের নাগরিকরা! যতই নিষ্প্রাণ, হিসাবি, প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন হন না কেন, বসন্তের এ দিনে তারা গেয়ে উঠবেন ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে/ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে…।’ যেন তাদের ‘হারিয়ে যেতে আজ নেই মানা।’
গ্রামেও এখন ফাগুনের ছোঁয়া। গাঁয়ের বধূরা আজ আঙিনা লেপে বরণ করে নেবে ফাগুনকে। তুলে রাখা হলদে শাড়িও বের করবে আজ। শুরু হবে বোরো চারা রোপণের পালা। মাঘের শীতে আবাদের মাঠে যেতে পারেননি কৃষক। ফাগুনের দিনে তারা স্বাচ্ছন্দ্যেই যেতে পারবেন। বসন্ত সবার হৃদয়ে এনে দেয় ফাগুনের দোলা।
বসন্ত মননে, চেতনায় ও সংগ্রামী প্রত্যয়ে বাঙালির প্রতিবিম্ব হোক, বিনাশ হোক সব অশুভ! পূর্ণতায় বসন্তের দোলা ছড়াক সর্বত্র, পৃথিবীর সব মানুষের ঘরে।